চক্ষু শী্তল সন্তান শিক্ষা ও পরিচর্যা
মহাবিশ্বে মানবশিশু এক অপার সম্ভাবনার নাম। এ শিশুরাই জীবনের সৌন্দর্য, প্রাণের স্পন্দন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,
الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيُوةِ الدُّنْيَا وَالْبَقِيتُ الصَّلِحْتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَ خَيْرٌ أَمَلًا .
অর্থ: “ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য এবং স্থায়ী সৎকর্মসমূহ আপনার পালনকর্তার কাছে প্রতিদান প্রাপ্তি ও আশা লাভের জন্যে উত্তম।” (সূরা আল-কাহাফ: আয়াত-৪৬)
এ বিপুল সম্ভাবনাকে অবশ্যম্ভাবী করার জন্য একান্ত প্রয়োজন শিশুর শিক্ষা ও পরিচর্যা। প্রাণিকুলের সবই জন্মমাত্র সেই প্রাণী হয়ে জন্মায়। কিন্তু মানুষই একমাত্র জীব, যার ‘মানুষ’ নামটি ধারণ করতে জীবনভর বিশেষ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। স্পানিশ শিক্ষাবিদ পাবলো ক্যাসালস বলেন:
“A child must know that he is a miracle, that since the beginning of the world there hasn’t been, and until the end of the world there will not be, another child like him.”
অর্থাৎ, “একজন শিশুকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে, সে একটি মিরাকল (অলৌকিক কিছু), জানতে হবে যে, পৃথিবীর শুরু থেকে এমন আর কেউ ছিলো না এবং পৃথিবীর শেষ দিন অবধি আর কোনো শিশু তার মতো হবে না”।
সুতরাং সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় মানব শিশুর অলৌকিক প্রতিভা বিকাশের জন্য এবং তাকে নয়নের মণি করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন যথোপযুক্ত শিক্ষা, শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ, শিশুতোষ শিক্ষা উপকরণ এবং বিশেষ পরিচর্যা।
শিক্ষাবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিশু শিক্ষা ও তার পরিচর্যাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এর কারণ যথাযথ শিক্ষা ও পরিচর্যা ছাড়া একটি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সম্ভব নয়। আর একেকটি পূর্ণবিকশিত শিশু একটি সফল জীবন পেরিয়ে একটি প্রত্যাশিত সম্ভাবনাময় পৃথিবী বিনির্মাণ করে। যে শিক্ষা মানুষকে মুত্তাকী, নৈতিক, ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ, দক্ষ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক ও সোনার মানুষ তৈরি করতে সহায়ক। বস্তুত সে শিক্ষাই শিশুর প্রয়োজন। আমি মনে করি সে শিক্ষাটিই হলো ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার সুসমন্বয় সাধনকারী মাদরাসা শিক্ষা। যে শিক্ষা পদ্ধতির অনুপম আলোক আভায় একটি শিশু চক্ষু শীতলকারী সন্তানরূপে গড়ে উঠতে পারে।
মনে রাখতে হবে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত চারটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। তা হলো:
১. জানতে শেখা (To know)
২. করতে শেখা (To do)
৩. বাঁচতে শেখা (To live)
৪. মিলেমিশে সুন্দরভাবে বসবাস করতে শেখা (To lead a successful life together)
প্রকৃতপক্ষে মানুষ সারাজীবন যা কিছু শেখে, তার সবই এ চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে শেখে। শিশু এর থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই শিখনের ভেতর দিয়ে শিশু শুধু তার ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলবে তা নয়; বরং সৃষ্টি করবে বিশ্লেষণ ও কাজ করার ক্ষমতা, সর্বোপরি চিন্তার জগৎকে বাস্তবতার নিরিখে সমৃদ্ধশালী ও মজবুত করার ক্ষমতা অর্জন করবে। শিশুর কল্পনাশক্তি অসাধারণ। কারণ, শিশু উন্মুক্ত চিন্তা করতে পারে, প্রশ্ন করতে পারে নিঃসংকোচে। এ চিন্তা করার শক্তিই রঙিন কল্পনার গোড়ার কথা। সেখানে তাকে ইসলামের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবকল্যাণের ইতিবাচক শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক বিষয়াবলির ধারণার সমন্বয় সাধন করা একান্ত জরুরী। আমেরিকার বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী টমাস বেরি এ প্রসঙ্গে বলেন:
Our children should be properly introduced to the world in which they live.”
আমাদের শিশুদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে সেই পৃথিবীর সাথে, যেখানে সে বসবাস করছে।
F.A.Q?
প্রশ্ন ১: সন্তানকে ইসলামি শিক্ষা কেন দেওয়া প্রয়োজন?
উত্তর:
ইসলামে সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামি শিক্ষা সন্তানকে আল্লাহর পরিচয়, ইসলামের মূলনীতি, নৈতিকতা, সততা এবং একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ শেখায়। এর মাধ্যমে সন্তান আখিরাতে সফলতা লাভ করতে পারে এবং দুনিয়াতেও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে।
প্রশ্ন ২: সন্তানকে ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার সঠিক সময় কখন?
উত্তর:
সন্তানকে ইসলামি শিক্ষা শুরু করা উচিত তার জন্মের সময় থেকেই। ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের কুরআন শেখানো, নামাজের গুরুত্ব বোঝানো এবং ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলি শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের পরিবারকে নামাজের জন্য আদেশ কর এবং নিজেও তা পালন কর।” (সূরা তাহা, ১৩২)
প্রশ্ন ৩: সন্তানকে ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার জন্য কি বিশেষ কৌশল প্রয়োজন?
উত্তর:
- সহজ ভাষায় শিক্ষা: ছোটদের জন্য ইসলামিক শিক্ষা সহজ ও পরিষ্কার ভাষায় দিতে হবে।
- উত্তম আচরণ: শিশুর সামনে ভালো আচরণ প্রদর্শন করে তাদের ইসলামী শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।
- কুরআন তিলাওয়াত: নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করা এবং সঠিক তাফসিরের মাধ্যমে তাদের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করা।
- জীবনমূল্য শিক্ষা: সন্তানকে ইসলামের নৈতিক শিক্ষা দেওয়া, যেমন সত্যবাদিতা, পরোপকারিতা, সৎ জীবন যাপন ইত্যাদি।
প্রশ্ন ৪: সন্তানকে কিভাবে নামাজ শেখানো উচিত?
উত্তর:
- প্রথমে আদর্শ দেখান: শিশুকে নামাজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য অভিভাবকদের নিজেদের নামাজ পড়া উচিত।
- ধীরে ধীরে শেখানো: ছোটবেলা থেকেই নামাজে অংশগ্রহণ করাতে শুরু করুন, এবং তাদের নামাজের মধ্যে আনতে ধীরে ধীরে প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি শেখান।
- পুরস্কৃত করা: নামাজ পড়ার জন্য সন্তানকে প্রশংসা করুন, এবং ছোট পুরস্কার দিয়ে তাদের উৎসাহিত করুন।
প্রশ্ন ৫: সন্তানকে ইসলামী শিষ্টাচার শিখানোর উপায় কী?
উত্তর:
- অভিভাবকরা উদাহরণ তৈরি করুন: সন্তানদের ভালো শিষ্টাচারের শিক্ষা দেওয়ার জন্য অভিভাবকদেরও সেই শিষ্টাচার অনুসরণ করতে হবে।
- মিষ্টি ভাষায় কথা বলা: তাদের সাথে কোমল ও মিষ্টি ভাষায় কথা বলা, এবং শান্তভাবে শিষ্টাচারের শিক্ষাগুলি বোঝানো।
- দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা: ভাল আচরণে শিশুদের প্রশংসা করা এবং খারাপ আচরণের জন্য শাসন করা।
প্রশ্ন ৬: ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে সন্তানের চরিত্র গঠনে কি সুবিধা হয়?
উত্তর:
ইসলামী শিক্ষা সন্তানকে সৎ, নম্র, ধৈর্যশীল, এবং সবার প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য শিখায়। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করে। এর ফলে তারা উজ্জ্বল চরিত্র গঠন করতে সক্ষম হয়, যা তাদের পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত জীবনে উপকারে আসে।
প্রশ্ন ৭: ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষ বই বা উপকরণ কি রয়েছে?
উত্তর:
হ্যাঁ, ইসলামি শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু বই এবং উপকরণ রয়েছে। কিছু পরিচিত বই হলো:
- “সীরাতে রাসূল (সা.)”
- কুরআন তাফসির (যেমন: তাফসির ইবন কাথির)
- ইসলামি গল্পের বই (যেমন: ইসলামী শিশু কাহিনী)
এছাড়া, ইসলামের মৌলিক শিক্ষা এবং ইসলামী চরিত্র গঠনের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং ভিডিও কনটেন্টও ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৮: সন্তানকে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভালো কাজ শেখানোর জন্য কী ধরনের পরিবেশ প্রয়োজন?
উত্তর:
সন্তানকে ইসলামিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি ইসলামী পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যেখানে আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং রাসূল (সা.)-এর হাদিসের আলোচনা হয়, নামাজ পড়া নিয়মিত হয় এবং পরিবারের সব সদস্য একে অপরকে সৎ পথে পরিচালিত করে। এমন পরিবেশ সন্তানকে ভালো শিক্ষা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত।
There are no reviews yet.